সুদ হারাম কেন? লেখক- মোঃ ফিরোজ কবির।


সুদ (রিবা) ইসলামে হারাম (নিষিদ্ধ) কেন, তার একটি শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। সুদকে হারাম ঘোষণার পেছনে ইসলামী নীতি, নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক কারণ রয়েছে। এখানে এর মূল কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:

১. অবিচার এবং শোষণ:

সুদ হল একটি শোষণমূলক অর্থনৈতিক লেনদেন, যেখানে ঋণদাতা কেবল ঋণ গ্রহীতার উপর অতিরিক্ত অর্থ চাপিয়ে দেয়, যা কোনো পণ্য বা সেবা থেকে উদ্ভূত নয়। এতে ঋণগ্রহীতা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ সে মূল ঋণের পাশাপাশি সুদের অর্থও পরিশোধ করতে বাধ্য হয়, যা তার আর্থিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।

  • ইসলামের দৃষ্টিকোণ:
    ইসলাম শোষণ এবং অন্যের ওপর অযথা চাপ সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ করেছে। যে কোনো লেনদেন যা একপক্ষকে ক্ষতির মুখে ফেলে এবং অন্যপক্ষকে অনুপাতিকভাবে লাভবান করে, তা ইসলামে ন্যায়সঙ্গত নয়। সুদ এই ধরনের শোষণমূলক লেনদেনের একটি উদাহরণ।

২. আর্থিক সমতার অভাব:

সুদ ব্যাংক বা ঋণদাতাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয়ের নিশ্চয়তা দেয়, তবে ঋণগ্রহীতা ঝুঁকি বা ন্যায্যতা থেকে মুক্ত থাকে না। এর ফলে ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধনী আরও ধনী হয়ে যায়। এটি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।

  • ইসলামের দৃষ্টিকোণ:
    ইসলামে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং সহানুভূতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুদ ব্যবস্থায় একপক্ষ লাভবান হয়, অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে। ইসলাম বাণিজ্যিক লেনদেন এবং ব্যবসায়িক চুক্তির ক্ষেত্রে সমতার এবং ন্যায্যতার প্রতি গুরুত্ব দেয়।

৩. সামাজিক অস্থিরতা:

সুদ সমাজে একটি বিভাজন তৈরি করে, যেখানে কিছু ধনী ব্যক্তিরা ঋণ থেকে সুদ উপার্জন করে তাদের আয় বাড়ায়, কিন্তু ঋণগ্রহীতারা অসহায় হয়ে পড়ে। এটি ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বাড়ায় এবং সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে।

  • ইসলামের দৃষ্টিকোণ:
    ইসলাম সমাজে শান্তি, সমতা এবং সহযোগিতার মূল্য রাখে। সুদ দরিদ্রদের শোষণ করে এবং ধনীদের আরও ধনী করে তোলে, যার ফলে সমাজে বৈষম্য ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সমাজে শান্তি ও সমতা বিঘ্নিত হয়।

৪. আধ্যাত্মিক ক্ষতি:

সুদ গ্রহণ বা প্রদান করা একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষতিকর। কুরআনে বলা হয়েছে যে সুদগ্রহণকারী আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের জন্য শাস্তি নির্ধারিত। সুদে লেনদেন করার মাধ্যমে একজন মুসলিম আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ এটি আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।

  • কুরআনে:
    "যে ব্যক্তি সুদ গ্রহণ থেকে বিরত না হয়, সে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।" (সূরা আল-বাকারা ২:২৭৯)

এখানে সুদ থেকে বিরত না হওয়াকে একটি বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং এটি আধ্যাত্মিক শাস্তির কারণ।

৫. ব্যবসা ও বিনিয়োগের বিকল্প:

ইসলাম ব্যবসা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ লাভ অর্জন করতে উৎসাহিত করে। যেখানে বিনিয়োগকারী ঝুঁকি নেয় এবং লাভের পাশাপাশি ক্ষতির সম্মুখীনও হতে পারে। সুদ এতে কোনো ঝুঁকি বা বিনিয়োগের অবদান রাখে না, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের জন্য অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়।

  • ইসলামের দৃষ্টিকোণ:
    ইসলাম ব্যবসা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ অর্জন করার পক্ষে, যেখানে প্রকৃত মূল্য তৈরি হয় এবং উভয় পক্ষ লাভবান হয়। সুদে কোনো উদ্যোগ বা সৃজনশীলতা নেই, তাই এটি ইসলামের শিক্ষা এবং দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধে।

৬. মনে এবং হৃদয়ে অস্থিরতা:

সুদে অর্থ উপার্জন প্রক্রিয়াটি এক ধরনের আত্মিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যারা সুদ গ্রহণ বা প্রদান করে তারা শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য চিন্তা করে, যা তাদের মনে এবং হৃদয়ে শান্তি আনে না।

  • ইসলামের দৃষ্টিকোণ:
    ইসলামে একজন মুসলিমের জন্য টাকা উপার্জনের পাশাপাশি ন্যায়সঙ্গততা, পরিস্কারতা এবং আত্মিক শান্তি অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ। সুদ থেকে আয়ের মাধ্যমে এমন শান্তি পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তা শোষণ এবং অবিচারের মধ্যে তৈরি হয়।

সারাংশ:

সুদ ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী হারাম (নিষিদ্ধ) কারণ এটি শোষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা, এবং আধ্যাত্মিক ক্ষতির সৃষ্টি করে। ইসলাম ব্যবসা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ ও ন্যায্য লাভ অর্জন করতে উৎসাহিত করে, যেখানে উভয় পক্ষ লাভবান হয় এবং কোনো অবিচার বা শোষণ নেই। সুদ গ্রহণ বা প্রদান একজন মুসলিমকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে এবং তাকে আধ্যাত্মিকভাবে বিপথগামী করতে পারে।

Comments

Popular posts from this blog

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শৈশব ও কৈশোর শৈশবকাল। লেখক মোঃ ফিরোজ কবির।

বিষয়ঃ বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে রাসুল (সা:) এর আদর্শ। লেখক মোঃ ফিরোজ কবির

হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর স্ত্রীদের নামসমূহ। লেখক- মোঃ ফিরোজ কবির।